পুইমাঁচা গল্পের বিষয়বস্তু সমালোচনা পর্ব-০২ (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

 



'পুঁইমাচা' গল্পের কাহিনী অংশ নগণ্য। কাহিনীর নিজস্ব কোনো অভাবিত চমক নেই, নেই কোনো আকর্ষণীয় অভিনবত্ব। অতি সাধারণ সহজ সরল গল্প। ঘটনাও যা ঘটেছে, সবই গ্রাম্য পরিবেশে ছোটখাটো পারিবারিক বিষয়গুলিকে কেন্দ্র করেই। গল্পের নায়িকা ক্ষেন্তি সহজ, সরল এবং ভোজনপ্রিয়। তার ভোজনপ্রিয়তা আধুনিক কোনো রুচির অনুবর্তী নয়, গ্রামেরই পরিবেশে সাধারণ সহজলভ্য কোনো প্রকৃতি-খাদ্যকে লক্ষ্যে রেখেই নিয়ন্ত্রিত। সামান্য এই লোভ ও বাসনাটুকু নিয়েই অতি-দারিদ্র্যের সংসারে মা অন্নপূর্ণার সঙ্গে তার বিরোধ বাধে। বিরোধ একতরফে, অর্থাৎ মা তার এই স্বভাবের বিরোধী। অন্নপূর্ণা মেয়েকে শাসন করে এমন লোভের জন্য, শাসন করে মেয়ে বড় হয়েও গ্রামের পথে বনে-বাদাড়ে বাবার সঙ্গে ঘুরে, কখনো বা একা, কখনো ছোট দুই মেয়ের সঙ্গে ঘুরে খাদ্যের উপযোগী শাক-পাতা সংগ্রহ করার জন্য। মেয়ে বড় হয়েছে, তার বিয়ের কথাও মাকে তাড়িত করে। এসব নিয়ে স্বামীর সঙ্গে অন্নপূর্ণার ঝগড়া হয়। অতি দারিদ্র্যের সংসারে এসব নিয়েই খুঁটিনাটি বিষয়-নির্ভর ঘটনা ঘটে। কোনো বড় মাপের ঘটনা এ কাহিনীতে নেই অবান্তর। বড় ঘটনা বলতে একমাত্র ক্ষেন্তির মৃত্যু। তা-ও লেখক এমনভাবে ঘটিয়েছেন যা সেকালের সেই গ্রাম্য সমাজ ও প্রাকৃতিক পরিবেশে যেনবা সদা সর্বজনগ্রাহ্য।


তবু ক্ষেন্তির মৃত্যু কাহিনীকে চরম পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। অনেক বয়স বেশি এক পুরুষের সঙ্গে ক্ষেন্তির বিয়ে হয় একদিন। স্বামীর ঘরে চলে যাওয়ার পর পণের টাকা ঠিকমতো না দেওয়ায় তার শাশুড়ির অপবাদ দেওয়া এবং ক্ষেন্তির ভোজনপ্রিয়তার 'অশালীন' রূপের জন্যে ক্ষেন্তির সঙ্গে পিত্রালয়ের যোগ বিচ্ছিন্ন হয়। শ্বশুরালয়ের দুর্ব্যবহারে, অবজ্ঞায়, অবহেলায় ক্ষেন্তির একদিন বসন্তরোগে মৃত্যু ঘটে। কাহিনীর শেষে এক সন্ধেয় পিঠে-পুলি তৈরির পরিবেশে অন্নপূর্ণার স্মৃতিতে ধরা, ক্ষেন্তির দুই ছোট বোন রাধী-পুঁটির কথোপকথনে ক্ষেন্তির স্মৃতি বড় হয়ে আসে। সেই স্মৃতির ব্যঞ্জনা ক্ষেন্তির রোপণ করা পুঁইগাছের বিবৃদ্ধি ও পুঁইমাচায় তার অবস্থানের প্রতীক হয়ে গল্পের সমাপ্তি আনে।


কাহিনীর শেষ 'ক্ষেন্তির মৃত্যুতে, কারণ ক্ষেন্তিই এই গল্পের নায়িকা, কিন্তু গল্পের শেষ লেখকের সেই সূত্রে ব্যবহৃত প্রতীকের ব্যঞ্জনায়। তাই কাহিনী বড় নয়, বড় হয়েছে লেখকের মানব ও প্রকৃতি-সম্পর্কিত রহস্য-গভীর ভাবনার কেন্দ্রই। 'পুঁইমাচা' গল্পের কাহিনীর বস্তুভিত্তি থাকলেও তা তুলনায় অকিঞ্চিৎকর, তার ঘটনাও লেখকের বাস্তবতার বিশেষ জ্ঞানে ধরা। কাহিনী এখানে কাঠামো মাত্র, গল্পের এক জটিল উদ্দেশ্যকে বহন করার উপযোগী আধার মাত্র। আবার অন্য অর্থে এই কাহিনীর অঙ্গে জড়িয়ে আছে গল্পের মূল লক্ষ্যও। তাই কাহিনী সহজ সরল কাঠামো হতে পারে, কিন্তু কেন্দ্রীয় লক্ষ্যে সূত্রবদ্ধ বলেই কাহিনী-বৃত্ত যথোচিত শিল্পমর্যাদা-সম্পন্ন। গল্পের প্রথম দিকে যে পুঁইচারাটি অসময়ে মাটিতে পুঁতে রেখে ক্ষেন্তি সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে তার অন্তর-রহস্যের প্রকাশ ঘটায়, গল্পের শেষে সেই পুঁইচারাই ক্ষেন্তির মৃত্যুকে উপলক্ষ্য করে প্রকৃতিপ্রদত্ত আপন জীবন-বেগে বড় হয়ে ওঠে, গল্পের ব্যঞ্জনায় গভীরতর সত্যটি স্পষ্ট করে। কাহিনীবৃত্তের এই সামান্য অংশটুকু ছোটগল্পের প্লটের অপরূপত্ব পেয়েছে। কাহিনী ও ঘটনাকে একেবারে সহজ, সরল, সাদামাটা রেখে গল্প বা উপন্যাসের আধারের শিল্পমর্যাদাকে বড় গৌরব দানের ক্ষমতা সেকালে একমাত্র বিভূতিভূষণের লেখনীতেই অসামান্য মূল্য পেয়েছে- এ-ব্যাপারে অন্য গল্পকার থেকে বিভূতিভূষণের স্বাতন্ত্র্য স্থায়ী।

পুইমাঁচা গল্পের বিষয়বস্তু পর্ব- ০১ দেখুন এখানে



গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে লেখকের অভিজ্ঞতা হল তাঁর শিল্পভাবনার একমাত্র মূলধন, আর এই মূলধনকে খাটানোর প্রধান আধার হল চরিত্র। কাহিনীবৃত্ত বা প্লট সেই অত্যদ্ভুত অভিজ্ঞতার বাহক চরিত্রগুলিকে যেনবা স্রোতের টানে বেগ দেয়। বিভূতিভূষণের 'পুঁইমাচা' গল্পের চরিত্রগুলি, আগেই বলেছি, সাদামাটা এবং গল্পের মূল লক্ষ্যকে ব্যঞ্জনাগর্ভ ও দীপিত করার কাজটুকু সমাধা করেই তারা তাদের শিল্পের সীমা চিহ্নিত করে দিয়েছে। তাই চরিত্র-প্রধান গল্পের মতো, যেমন, একাধিক সার্থক গল্পের লেখক তারাশঙ্করের চরিত্র-চিত্রণের মতো, 'পুঁইমাচা' গুরুত্ব পায়নি।


'পুঁইমাচা' গল্পে একাধিক চরিত্র আছে- ক্ষেন্তি, ক্ষেন্তির পিতা সহায়হরি চাটুজ্যে, মা অন্নপূর্ণা এরাই আমাদের প্রধান দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরা ছাড়া কালীময় চৌধুরী, বিষ্ণু সরকার, এমনকি ক্ষেন্তির দুই বোন পুঁটি ও রাধীদেরও গল্পে কিছু নড়াচড়া লক্ষ করি। চরিত্র হিসেবে ক্ষেন্তিই গল্পের মূল লক্ষ্য এবং কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু এই চরিত্র যেন গ্রাম্য- প্রকৃতির রাংতায় মোড়া। সে কথা বলে কম, তার ভোজনপ্রিয়তা স্বভাবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কিন্তু দারিদ্র্যের সংসারে তার ভোজনপ্রিয়তা তার উদগ্র ঔদরিক স্বভাবের গ্লানি আনে না, বরং এক গ্রাম্য কিশোরীর একেবারে স্বাভাবিক জীবনযাপন-বৃত্তির সঙ্গে তা ওতপ্রোত থাকে। তাই ক্ষেন্তির মৃত্যু আমাদের হৃদয়, মমত্ববোধ স্বতঃস্ফূর্তভাবে টানে। তার মৃত্যু আমাদের যেমন বেদনা জাগায়, তার চলে যাওয়ার স্মৃতিসূত্রটি যখন লেখক তারই লাগানো পুঁইগাছ ও পুঁইমাচার ব্যঞ্জনায় এনে হঠাৎ নীরব হয়ে যান, তখন তার বেঁচে থাকার অসহায়তা ও তার প্রতি নিয়তির নির্মম প্রহার আমাদের একেবারে মর্মে গিয়ে ঘা মারে। গল্পের অন্তিম প্রতীক বিশেষ এক ক্ষেন্তির সাধারণ চরিত্ররূপকে অসাধারণ, অলৌকিক এক চরিত্র-স্বরূপে নির্বিশেষ করে তোলে। একাধিক ক্ষেত্রে মায়ের কাছে ধরা পড়ে গিয়েও তার সভয় সত্যভাষণ, যে পুঁইশাক চিংড়ি মাছ দিয়ে খাওয়ার লোভ সেই পুঁইচারা রোপণ ও তাকে খেলার ছলেই বড় করার গোপন-মধুর বাসনা, পৌষ সংক্রান্তিতে দারিদ্র্যের সংসারে পিঠে খাওয়ার অদম্য আবেগ এবং স্বাদগ্রহণের কৌতূহল-এসব আমাদের ক্ষেন্তির অনেক কাছের করে তোলে। মায়ের নিরন্তর স্নেহে- শাসনে ক্ষেন্তির সত্যিকারের স্বভাব অন্নপূর্ণার ভাবনাতেই ব্যক্ত- 'ক্ষেন্তি আমার যার ঘরে যাবে, তাদের অনেক সুখ দেবে। এমন ভালোমানুষ, কাজে-কর্মে ৰকো, মারো, গাল দাও টু শব্দটি মুখে নেই। উঁচু কথা কখনো কেউ শোনে নি'। এমন ক্ষেন্তি বিবাহের পরেও বাবা-মাকে ভুলতে পারেনি। বস্তুত এমন ক্ষেন্তি চরিত্রটি গ্রামের প্রাকৃতিক পটভূমিতে প্রকৃতিরই লাবণ্য, বিভা। নীরব প্রকৃতি আর জীবনে-মরণে নিশ্চুপ ক্ষেন্তি এক।


সহায়হরি চাটুজ্যে গ্রামেরই উপযোগী এক উদাসীন সংসারী মানুষ। তার সাংসারিক দারিদ্র্য তাকে জ্বালা ধরায় না, ক্ষোভে ভেঙে দেয় না, বরং সে-ও মেয়ের মতো প্রকৃতির বুকে সাংসারিক সমস্ত রকম সীমাবদ্ধতা ও অসঙ্গতি থেকে মুক্তির স্বাদ নেয়। তার মধ্যে কন্যার প্রতি স্নেহ যেমন প্রবল, তেমনি কন্যার অপাত্রে বিবাহ-দানের যুক্তিপূর্ণ বিরোধিতার দিকও স্পষ্ট। দুঃখের কারণে তার আভিজাত্যের গৌরব এতটুকু ম্লান হয়নি তার মধ্যে। তার স্নেহ-মমতা, দোষ-ত্রুটি সবই মানানসই। অন্নপূর্ণা দরিদ্র গ্রাম্যজননীর সার্থক প্রতিরূপ। যেন মাটির ঘ্রাণ তার চরিত্রে মেলে। একদিকে ক্ষোভ-দুঃখ-অসহায়তা, অন্যদিকে কন্যাদের প্রতি, বিশেষ করে ক্ষেন্তির প্রতি চন্দন গন্ধের মতো গভীর স্নেহ, মমতা তাকে প্রকৃতির অঙ্কশায়ী চরিত্র করে তুলেছে।

শাস্তি গল্পের সার সংক্ষেপ এখানে


কালীময় চৌধুরী গল্পের সে সময়ের সমাজ-ব্যবস্থার যথাযথ প্রতিরূপ অঙ্কনের ক্ষেত্রে সার্থক চরিত্র। সমাজপতিদের স্বার্থসর্বস্বতা, ধূর্তামি, ভণ্ডামি যে কি রূপ নেয় এই চরিত্র তা প্রমাণ করে। বিষ্ণু সরকার প্রসঙ্গটি সেকালের পণপ্রথার মানবতাহীন পরিণামকে তুলে ধরে। হিন্দুমতে আদিতে ছিল যে কোনো দানে দক্ষিণা প্রদানের রীতি এবং সেই সূত্রেই পিতা কর্তৃক বিবাহে তার কন্যাদানে সামান্য দক্ষিণা প্রদত্ত হত। ক্রমশ সেই দক্ষিণাই হয় যৌতুক। পণপ্রথাটি আসে বরপক্ষের দাবি হয়ে। সহায়হরি কন্যার বিবাহে সেই পণ যথাযথ দিতে পারেনি বলে যেভাবে ক্ষেন্তির প্রতি অমানবিক অত্যাচার হয় এবং ক্ষেন্তির মৃত্যু ঘটে, তা 'পুঁইমাচা' গল্পে দলিল হয়ে লিখিত হয়েছে। বিভূতিভূষণের সমকালীন সমাজ-ভাবনা, যে সমাজ-ভাবনার প্রথম প্রতিফলন রবীন্দ্রনাথের 'দেনাপাওনা' গল্পে, 'পুঁইমাচা' গল্পে তা-ই কঠিন বাস্তবতায় অঙ্কিত। 'পুঁইমাচা' গল্পের চরিত্রগুলি যে সমকালীন সমাজ-ন্যায়কে মেনে নিয়েই অঙ্কিত এবং কাহিনী-সূত্র নায়িকার সঙ্গে প্রকৃতির স্বভাবের বৈপরীত্যেই নায়িকার মূল্যায়নে যথার্থতা পেয়েছে, সেখানেই এদের অনন্যতা।


সমালোচনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে: বাংলা ছোটোগল্প প্রসঙ্গ ও প্রকরণ: বীরেন্দ্র দত্ত, পৃষ্ঠা নং ৩১২-৩১৫, পুস্তক বিপণি পাবলিকেশন, কলকাতা। প্রথম প্রকাশ- আগস্ট ১৯৮৫,

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন