পুইমাঁচা গল্পের বিষয়বস্তু সমালোচনা পর্ব-০১ (বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

 




ডঃ সুকুমার সেন 'পুঁইমাচা' গল্পটিতে বিভূতিভূষণের সবচেয়ে বিখ্যাত উপন্যাস 'পথের পাঁচালী'র বীজ লক্ষ করেছেন। আগেই বলেছি, 'পুঁইমাচা'র প্রথম প্রকাশ ঘটে প্রবাসী পত্রিকার ১৩৩১ সালের মাঘ সংখ্যায়। 'পথের পাঁচালী'র প্রথম লেখা শুরু ১৭ই বৈশাখ, ১৩৩২। স্বভাবতই এই হিসাবে 'পুঁইমাচা' 'পথের পাঁচালী'র পূর্ববর্তী রচনা। এই দুই গল্প ও উপন্যাসে আছে বাংলার গ্রামজীবন, সহজ সরল শান্ত প্রকৃতি আর তীব্র দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বাঁধা মানব-মানবীর জীবনের উজ্জ্বল প্রেক্ষিত।


যাঁরা উপন্যাস লেখেন, তাঁদের মনের গভীরে তার একটি ছক কোনো না কোনো ভাবে প্রত্যক্ষে অথবা অগোচরে তৈরি হতে থাকে। এই দিক থেকে 'পথের পাঁচালী'র খসড়া রূপ হিসেবে 'পুঁইমাচা'র কল্পনাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। সেই গ্রাম, সেই মানুষ, সেই প্রকৃতি যেন একই মায়ের নাড়ীর যোগে দুই ছোট-বড় সন্তানের জন্ম- রূপ তুলে ধরে এই দুই শিল্পরূপে। 'পুঁইমাচা'র ক্ষেন্তি, সহায়হরি চাটুজ্যে, অন্নপূর্ণা যেন যথাক্রমে দুর্গা, হরিহর, সর্বজয়ার পূর্বাগত ছায়া। তফাত শুধু ছোটগল্পের সংক্ষিপ্ত, সংহত, ব্যঞ্জনাময় পরিসরে শিল্পের তাগিদে ক্ষেন্তিকে বিবাহ দিতে হয়েছে, বিবাহের পর তার হয়েছে মৃত্যু, আর এই মৃত্যুই গল্পের মধ্যে আবার বৈপরীত্যের ব্যঞ্জনা এনেছে প্রকৃতি- মানুষের সম্পর্কের মৌল তাৎপর্যে। 'পথের পাঁচালী'তে দুর্গার বিবাহের প্রয়োজন হয়নি, কারণ তার মৃত্যু উপন্যাসের দীর্ঘ পথকে জীবন ও প্রকৃতির এবং অন্তর্নিহিত সম্পর্কের আরও বড় ডাইমেনশানের ব্যঞ্জনা দেয়। 'পুঁইমাচা' গল্পে আছে প্রকৃতির পটভূমিতে জীবন-মৃত্যুর রহস্য, জীবনের বিপরীতে প্রকৃতির নিরাসক্ত নির্মমতা। আসল কথা, এ গল্পে প্রকৃতিই একমাত্র নিয়ামক শক্তি। 'তৃণাঙ্কুর' বিভূতিভূষণের একেবারেই আত্মজীবনী ধরনের রচনা। এর এক জায়গায় লেখক বলেছেন, 'এই পৃথিবীর একটা spiritual nature আছে। আমরা এর গাছপালার, ফুল-ফল, আলো-ছায়া, আকাশ-বাতাসের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেছি বলে, শৈশব থেকে এদের ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের বন্ধনে আবদ্ধ বলে, এর প্রকৃত রূপটি অনুধাবন করা আমাদের বড় কঠিন হয়ে পড়ে।' বাস্তবিক পক্ষে সেই supernatural nature-কে বিভূতিভূষণ যে নানাভাবে, এই বস্তু-পৃথিবীর অন্তর্গত মানব সংসারে নানা আধারে রেখে গভীর-সন্ধিৎসু হয়েছেন, একেবারে প্রথম দিকের সার্থকতম গল্প 'পুঁইমাচা'-য় তার প্রাথমিক অথচ বলিষ্ঠ পদক্ষেপ লক্ষ করি।

পুইমাচা গল্পের সমালোচনা দ্বিতীয় পর্ব দেখুন

যে সময়ের প্রেক্ষাপটে 'পুঁইমাচা' গল্পের সৃষ্টি, সেই সময়ে বিভূতিভূষণের প্রকৃতি- মনস্কতার পাশে আরও কয়েকজনের প্রকৃতি-ভাবনার কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করতেই হয়। আমরা গ্রহসনাথ রবীন্দ্রনাথকে পূর্ণ মহিমায় লক্ষ করি একালে। একালে একই আকাশে সূর্যের পাশে চন্দ্রের মতো আছেন শরৎচন্দ্র। প্রথম মহাযুদ্ধ-পরবর্তী কালের অন্তর্গ্য পাশে প্রতিক্রিয়ায় দেখা দিয়েছে 'কল্লোল-প্রপতি কালিকলমে'র মতো পকিন্স ও স্বদেশীয় শিক-গোষ্ঠীর কবিকুলে দেখা দিয়েছেন তরুণ কবি জীবনানন্দ দাশ। আর আছেন রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে, তাঁকে প্রণাম জানিয়ে একদল রবীন্দ্রানুসারী কবিগোষ্ঠী- যাঁদের মধ্যে কালিদাস রায়, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, কুমুদরঞ্জন মল্লিক প্রমুখের নাম করতেই হয়। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, এসময়ে ইংল্যান্ডে টি. এস. এলিয়ট তাঁর রচনায় স্পষ্ট করেই বলেছেন -'We are the hollow men', বলেছেন 'Everyone is alone, or it seems to me'. -এসব কথা প্রথম মহাযুদ্ধ-উত্তর বুদ্ধিজীবীদের মানস- প্রতিক্রিয়ার আন্তরিক ভাষারূপ। আর এই ভাবনার সাযুজ্যে এদেশীয় কবি জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ কল্লোলীয় কবি তাঁদের প্রকৃতি-ভাবনাকে সময়ের ইতি-নেতির সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়েছেন। মোহিতলাল মজুমদার, যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত প্রমুখ কবি রবীন্দ্র- বিরোধী প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা বিরূপ-ভাবনার অস্বস্তিকে সফল করেছেন কাব্যের বিষয়ে প্রকৃতি চেতনায়।


বিভূতিভূষণকে এমন সব পরস্পর-বিরোধী প্রকৃতিরূপের ও সময়ের প্রহারের মধ্যে প্রকৃতিতে নিমজ্জিত-মুখ হতে হয়েছে। ক্রমশ প্রকৃতি-সম্পর্কিত জটিল তত্ত্বের 'ক্রুশ- কারেন্ট' থেকে বেরিয়ে এসে একসময়ে তিনি হয়েছেন 'বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতিচেতনার এক প্রবাদ-পুরুষ কথাকার।' বিভূতিভূষণের প্রকৃতি-ভাবনা তাঁর একান্ত নিজস্ব অন্তরঙ্গ বস্তু, তার বিশেষ জীবনচর্যায় (attitude to life) নিয়ামক শক্তি। এবং এই সংজ্ঞায় যদি কোনো দর্শনের কথা মনে করায় এই লেখকের রচনা, তা প্রকৃতি-প্রভাবিত ও পরিশীলিত সর্বাংশে নিশ্চয়ই।

পুই মাঁচা গল্পের নামরকরণ জানতে দেখুন


সমসাময়িক শরৎচন্দ্রের গল্প-উপন্যাসে প্রধান পটভূমি হয়েছে গ্রামবাংলা। আর এই গ্রামবাংলার ছবি, এর মানুষজন, এর সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থার সমন্বয়ে মোটামুটি রূপ নিয়েছে। কিন্তু শরৎচন্দ্র কথাকার হিসেবে যতটা পল্লীবাংলাকে নিয়েছেন, তার মানুষজনকে নিয়েছেন, ততটুকুই থেকে গেছে সার্বিক শিল্পবিচারের ক্ষেত্রে-তার কোনো উত্তরণ ঘটেনি বড় তাৎপর্যে। শরৎচন্দ্র শুধু হয়েছেন সাধারণ অর্থে সেকালের গ্রামবাংলার কথাকার। কথাটা মর্যাদা পায় রবীন্দ্রনাথের নাগরিক চেতনার পাশে প্রতিক্রিয়া হিসেবে। কিন্তু সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ সূক্ষ্ম অর্থে রক্তের সম্বন্ধে তাঁর বিশেষ প্রকৃতি-ভাবনাকে গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, নাটক-সর্বত্র, বলা যায়, লেপে দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের হাতে প্রকৃতির এক অভিনব সজ্জা, তাৎপর্য। এ সময়ের পাঠক রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি-ভাবনার সঙ্গে সম্যক পরিচিত।


পাশাপাশি জীবনানন্দের যেহেতু ছিল এক পাশ্চাত্য শিক্ষায় দীপিত আধুনিক মন ও মনন, তিনি তাই তাঁর সময়ের পীড়িত পরিবেশ থেকে মুক্তির আর্তিতে সমগ্র পৃথিবীর মূলে কোথাও বুঝি কোনো গভীর ক্ষত তৈরি হতে শুরু করেছে-এমন বোধে বিশ্বাস রেখে প্রকৃতিকে দেখতে চেয়েছেন। এই অর্থে জীবনানন্দ হলেন প্রকৃষ্টভাবে প্রথম মহাযুদ্ধোত্তর কালের দ্বন্দ্ব-দীর্ণ বিশ শতকীয় সভ্যতা-সচেতন প্রকৃতির কবি। অন্যদিকে বিভূতিভূষণ প্রকৃতি ভাবনায় ভিন্ন মেরুগামী। সংশয়াচ্ছন্ন দ্বন্দ্বসংকুল অস্থির সভ্যতার আর্তি তার প্রকৃতি-ভাবনায় এতটুকুও ক্রিয়া করেনি। তিনি প্রকৃতিকে জীবনের অনুষঙ্গী করে স্ব-রূপে চিত্রিত করেছেন। প্রকৃতি জীবনশক্তির একমাত্র নিয়ামক নিষ্ঠুর শক্তি। জীবনের পৌরুষ যতই প্রকৃতিকে জয় করুক, প্রকৃতি জীবনকে যেমন সেলাম করে, তেমনি অবলীলায় ধ্বংসও করে, তা করার পর আপন স্বভাবে নিরাসক্তিতে আপন বেগেই তার গতিময়তা! এমন একটা ভাবনা বিভূতিভূষণের প্রকৃতি-চেতনায় নিহিত। এই চেতনায় কোনো দর্শন আছে কিনা পরে বিচার্য, তবে রোমান্টিক কৌতূহলে বিভূতিভূষণ প্রকৃতিকে অনুসন্ধান করেছেন, তার রহস্যের জটের উৎসকে ধরতে চেয়েছেন।


রবীন্দ্র-অনুজ কবিদের হাতে কিন্তু এমন রহস্যসন্ধানী প্রকৃতিরূপ আমরা পাই না। তাঁদের প্রকৃতি চেতনায় পল্লীজীবন-ভাবনার সূত্র নিশ্চয়ই 'উপরিতলভিত্তিক' (superfi- cial)। এই কবিদের সাধারণভাবেই চোখের ঠিক নিচেই ছিল মন, আর এই মন দিয়েই মুখ্যত প্রকৃতির কখনো মনোরূপ, কখনো বা দুঃখময় ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর রূপের প্রতিচিত্রণে ব্যস্ত হয়েছেন কবিতায়। প্রকৃতি যা, সেইভাবেই তাকে সুন্দর করে এঁকে যাওয়ার চেষ্টাতেই এঁদের প্রকৃতি-চিন্তার গুরুত্ব।


রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি-ভাবনা বিশ্বপ্রসারী। 'গল্পগুচ্ছে' যে গ্রাম-প্রকৃতির চিত্র এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ, সোনার তরী-চিত্রা কাব্যগ্রন্থের ও পরবর্তীকালের প্রকৃতি-ভাবনার সঙ্গে তার যোগ নিবিড়তম-আয়নায় দেখা কায়া ও ছায়া! রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি-ভাবনা মর্ত্যপ্রীতি তথা জীবনপ্রীতির কক্ষশায়ী। এবং পরিণামে জীবনের ব্যাপক ও বড় জীবনের সম্ভাবনায় সূক্ষ্ম তাৎপর্যে সেই প্রকৃতির যথাযথ মূল্যায়ন ঘটেছে। বিভূতিভূষণের প্রকৃতি তা থেকে অন্যপথের সন্ধানী। এ সন্ধান-প্রয়াস একান্তভাবে তাঁর নিজস্ব। বিভূতিভূষণের কাছে প্রকৃতি জীবনেরই একটা অংশ। রবীন্দ্রনাথ যে প্রকৃতিকে আবিষ্কার করেছেন, তা মহৎ কবির আবেগের দীপ্ত, রঞ্জিত, বিভূতিভূষণের সেক্ষেত্রে আছে অসীম কৌতূহল। বিভূতিভূষণের একটা কবিমন ছিল, তা অবশ্যই যুক্তি দিয়ে জীবনকে জানার ব্যগ্রতার সঙ্গে সম্যক সমন্বিত, কিন্তু এই যুক্তি নাগরিক-চেতনাজাত নয়, পল্লীজীবন ও প্রকৃতি- পরিবেশ লালিত চিরকালের মানবজীবন ও সংসারের প্রতিরূপে বৈপরীত্য থেকে জন্ম- নেওয়া। বিভূতিভূষণ বাস্তব জীবনকে জানতে চান, বুঝতে চান তার অন্তর্নিহিত সুখ- দুঃখ, ভালোবাসা, মমতা, মান-অভিমান-সব কিছুকে মানবিক বোধের মাপকাঠিতে আনতে চান। এখানে তিনি ঔপন্যাসিকের স্বভাবধর্ম সঠিক বজায় রেখেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি-সুলভ কৌতূহলের সঙ্গে যোগ হয়েছে রহস্যময় প্রকৃতিকে রোমান্টিক দৃষ্টিতে বোঝার কবিমন।


প্রধানত একজন সতর্ক কথাকারের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি ও ব্যক্তিত্বনিহিত কবিদৃষ্টি- দু'য়ের সমাপতনে বিভূতিভূষণের প্রকৃতি-ভাবনা লোভনীয় স্বাতস্থ্য আনে রবীন্দ্রনাথ থেকে। তিরিশের কালে কোবিদ কবি রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি চেতনার ঋদ্ধ রূপায়ণের পাশে বিভূতিভূষণ নিজস্ব ক্ষমতার গৌরব-গরিমা বজায় রেখেছেন। এই নিজস্বতা প্রমাণ হয়ে ঘায় রবীন্দ্রানুসারী কবিসমাজের প্রকৃতি-সম্পর্কিত চিন্তাভাবনা থেকেও। একই সময়ে কথাকার হিসেবে অসম্ভব জনপ্রিয় শরৎচন্দ্র। কথাকার বিভূতিভূষণ মোহময় জনপ্রিয়তায় নয়, সত্যিকারের জীবন ও প্রকৃতি-ব্যাখ্যায় অন্য জাতের ও ধাতের যে কথাকার হতে পেরেছেন, সময়ের পাঠক-জনতার রুচির সম্যক বদলে সহায়ক হয়েছেন, তার কারণ হল, বা তার চিহ্নিত শক্তি হল বিভূতিভূষণের রচনার প্রকৃতি-প্রয়োগের বিশিষ্টতা।

ভিখু চরিত্র প্রাগৈতিহাসিক গল্প ভিখু


দুই 


এমন প্রকৃতি-ভাবনার বিশিষ্টতায় 'পুঁইমাচা' গল্পটি 'পথের পাঁচালী'র মতোই লেখকের সার্থকতম রচনা। পুঁইমাচার কেন্দ্রীয় লক্ষ্যটিই প্রকৃতি। এই লক্ষ্যে ক্ষেন্তির মতো একটা গ্রাম-বাংলার সহজ সরল কিশোরী যুক্ত হয়ে যাওয়ায় গল্পটি কথাকারের অপরূপ শিল্প-স্বাদের ফসল হয়ে উঠেছে। 'পুঁইমাচা' গল্পের শ্রেণী নির্ণয় করতে হলে একে রোমান্টিক প্রকৃতি-ভাবনার গল্প বলাই সঙ্গত। এ গল্পের স্বাভাবিক টানের মধ্যে সমকালীন সমাজ-সমস্যা আছে, কোনো কোনো চরিত্রে স্বাতন্ত্র্যও দুর্লক্ষ্য নয়, গ্রাম্য একটি দরিদ্রের সংসারের বাস্তব প্রতিরূপও আছে, কিন্তু এসব ছাড়িয়ে বড় হয়েছে রহস্যময় প্রকৃতির গভীরতম তাৎপর্য এবং সম্ভব হয়েছে মানুষের সমন্বয়ে মানুষের ভাগ্য-ব্যাখ্যায়। আমরা এমন শ্রেণীনির্ণয়ের সিদ্ধান্তে আসি এই কারণে যে, গল্পের অন্তিমে কথাকার যে প্রতীকী- ব্যঞ্জনা এনেছেন তা একেবারে প্রকৃতির মূল রহস্যের দিকে তার 'pointing finger'কে স্থির রাখে। সমস্ত অভাব-অভিযোগ, অসহায়তা, মৃত্যু তুচ্ছ হয়ে যায় প্রকৃতির অমোঘ গতিময়তায়।


আবার সমগ্র গল্পটির পটভূমিতে আছে বাংলার এক প্রকৃতি-লালিত শান্ত গ্রাম, তার মানুষজন, তার গাছপালা, ফলমূল। ক্ষেন্তির বাবা সহায়হরি চাটুজ্যের যে আচার-আচরণ, সংসার-জীবনের জটিল দায়-দায়িত্ব সম্বন্ধে নিরাসক্তি তা-ও একান্তভাবে গ্রামেরই, কোনোমতেই শহরের নয়। তার স্ত্রী অন্নপূর্ণার যে উৎকণ্ঠা, আবেগ, স্নেহ, আর্তি, ভয়, যন্ত্রণা ও সংকট, হতাশা ও আশা- তা-ও শান্ত এক গ্রামজীবনেরই দারিদ্র্যে পোেড়-খাওয়া সংসারী বধূর। যে স্বামী-স্ত্রীর সংসার-চিত্রের বাস্তবতা সমগ্র গল্পে crude reality-র জগৎকে স্বভাবী পাঠকদের সামনে আনে, তা-ও এমন প্রকৃতি-পরিবেশ-নির্ভর গ্রামেই সার্থকভাবে আঁকা সম্ভব।


'পুঁইমাচা' গল্পের যে নায়িকা বড় মেয়ে ক্ষেন্তি- সে-ও প্রকৃতির সঙ্গে এমনভাবে রক্তের আত্মীয়তায় লেগে থাকে যে, গল্পের মধ্যে ক্ষেন্তিকে ধরে টান দিলে, গল্প থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করলে গল্পের শেষের সেই বেড়ে-ওঠা পুঁইমাচাতেও টান পড়ে প্রবলভাবে। ক্ষেন্তি সহজ, সরল, অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন, ভোজনপ্রিয় মেয়ে। তার স্বভাবের মধ্যেকার শান্ত রূপটি নির্বাক চলাফেরায়, বাবা-মার অনুগত স্বভাবে প্রকাশ পায়। যে স্বভাবে সে সারা

গল্পে চিত্রিত, গল্পের শেষে সেই স্বভাবেই আসে প্রকৃতি। তাই মায়ের জঠরের ভ্রূণটিকে অপরিমিত অবস্থায় প্রবল বেগে টেনে বের করে নেওয়ার চেষ্টা করা হলে মায়ের যেমন প্রাণসংশয় অবধারিত হয়ে ওঠে, যেমন মাতৃশরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার অক্ষম শক্তি- প্রয়োগের ফলে সপ্রাণ ভ্রূণেরও জীবনবিনাশ হওয়ার শঙ্কা সত্য হয়, তেমনি গল্পের সঙ্গে ক্ষেন্তির সেই সম্পর্ক-ভাবনা গল্পের মৌলিক মূল্যবিচারে একমাত্র সত্য হয়ে ওঠে। গল্পের শেষে বিভূতিভূষণ 'সুপুষ্ট, নধর, প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর' যে পুঁইমাচাটির চিত্র এঁকেছেন, তা যেন তুলনায় ক্ষেন্তির অস্তিত্বকেই সারা গল্পের অবয়বে ব্যাখ্যার সহায়ক হয়, অর্থাৎ একমাত্র ক্ষেপ্তিই বুঝিবা সমগ্র 'পুঁইমাচা' গল্পের একমাত্র লাবণ্য।


বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল তীব্র রোমান্টিক কবি মন। তাঁর প্রতীক প্রয়োগে সেই মন সক্রিয়। মার্জোরি বুলটনের মতে একজন কবি 'chooses an image to express his own experience for himself'। 'পুঁইমাচা' গল্পের শেষে লেখক যে একটি কল্প-চিত্রকে কয়েকটি বাক্যবন্ধের গাঢ়তায় এঁকেছেন, তার মধ্যে লেখকের' রোমান্টিক মনের উত্তুঙ্গ স্বভাব স্পষ্ট হয়ে যায়। মৃত্যু মানুষের সবচেয়ে crude reality কিন্তু এই মৃত্যুকে রোমান্টিক কবি-কথাকার যখন কোনো প্রতীকের সঙ্গে যোগে বৈপরীত্যে জীবন-দর্শনের উপযোগী বড় ব্যঞ্জনা দান করেন, তখন মৃত্যু reality থেকে romantic ideality-র গভীর-সন্নিহিত হয়ে পড়ে। ক্ষেন্তির মৃত্যু নিষ্ঠুর সত্য ও বাস্তব। লেখক তাকে নধর পুঁইগাছের সঙ্গে যোগে ব্যাপক অর্থ-তাৎপর্য দিয়েছেন। এখানেই বিভূতিভূষণের রোমান্টিক মনের বড় বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে।

শাস্তি গল্পের সার সংক্ষেপ এখানে


প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের জীবন ও মৃত্যুর যোগে বর্তমান লেখক এক গভীর বেদনাকে অন্তঃশীল রেখেছেন। রোমান্টিকদের অন্যতম বৈশিষ্ট্যই হল সুখ নয় অ-সুখ, শান্তি নয় অ-শান্তি, তৃপ্তি নয় অ-তৃপ্তির মধ্যে যে এক গভীর নিরুদ্দেশ বিষাদ-বেদনা সক্রিয় থাকে, তাকেই জিইয়ে রাখা রচনার সিদ্ধান্ত। 'পুঁইমাচা' গল্পে ক্ষেন্তির পোঁতা 'প্রবর্ধমান জীবনের লাবণ্যে ভরপুর' পুঁইচারার মধ্যে বিভূতিভূষণ প্রচ্ছন্ন রেখেছেন পরোক্ষে ক্ষেন্তির জন্য গভীর দীর্ঘশ্বাস। পুঁইচারা যেন জীবন্ত ক্ষেন্তির লোভী-বাসনা ও মৃত ক্ষেন্তির অসহায় বিষাদের মিলিত অস্তিত্ব। এই চিত্রে প্রকৃতির দুর্মর, দুরন্ত, সর্বকালিক জয় ঘোষণা আছে ঠিকই, কিন্তু এসবের অধিতলে মহাভারতের শেষে যদুবংশ ধ্বংসের পর্বে কালপুরুষের ছায়ার সবার অলক্ষ্যে নিশ্চুপ সঞ্চরমান থাকার মতো ক্ষেন্তির অসহায় মৃত্যুজনিত দুঃখের বেদনা ও বিষাদের ছায়া লেগেই থাকে। তা হল রোমান্টিক প্রকৃতি-প্রেমীর সেই 'ইমেজ' সৃষ্টির অভ্যন্তরস্থ বিপরীত ভাব-সংঘর্ষজাত উল্লাস-বিষাদের মিশ্র-ক্রিয়ার বিস্ময়কর দিক। 'পুঁইমাচা' গল্পের প্রকৃতি এক রোমান্টিক কবি-কথাকারের তৃতীয় নয়নের সামনে ধরা স্বচ্ছ আয়নার প্রতিবিম্ব।



সমালোচনাটি সংগ্রহ করা হয়েছে: বাংলা ছোটোগল্প প্রসঙ্গ ও প্রকরণ: বীরেন্দ্র দত্ত, পৃষ্ঠা নং ৩১০-৩১২, পুস্তক বিপণি পাবলিকেশন, কলকাতা। প্রথম প্রকাশ- আগস্ট ১৯৮৫,



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন