সোনার তরী কবিতার মূলভাব ও বিষয়বস্তু। সোনার তরী; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 



সোনার তরী কবিতার মূলভাব।

নাম             : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
জন্মতারিখ       : ৭ মে, ১৮৬১ খ্রি: (২৫ বৈশাখ, ১২৬৮)

পিতার নাম      : মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। 

মাতার নাম      : সারদা দেবী।

পিতামহের নাম  : প্রিন্স দ্বারকনাথ ঠাকুর।

শিক্ষাজীবন      : রবীন্দ্রনাথ বাল্যকালে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি, সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করলেও স্কুলের পাঠ শেষ করতে পারে নি। ১৭ বছর বয়সে ব্যারিস্টারি পড়তে ইংল্যান্ড গেলেও কোর্স সম্পন্ন করা সম্ভব হয় নি। তবে গৃহ শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জনের কোনো ত্রুটি হয় নি। 

পেশা / কর্মজীবন : ১৮৮৪ খ্রি. থেকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার আদেশে বিষয়কর্ম পরিদর্শনে নিযুক্ত হন এবং ১৮৯০ থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদারি দেখাশুনা করেন। এ সূত্রে তিনি কুষ্টিয়ার শিলাইদাহ ও সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর দীর্ঘ সময় অবস্থান করেন।

ছদ্মনাম        ভানুসিংহ ঠাকুর।

জীবনাবসান    :   মৃত্যু তারিখ  : ৭ আগস্ট, ১৯৪১(২২ শ্রাবণ ১৩৪৮ বঙ্গাব্দ)

সাহিত্যকর্ম

কাব্য          :   সন্ধ্যা সঙ্গীত, প্রভাত সংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল, মানসী, সোনার তরী, চিত্রা, চৈতালী, ক্ষণিকা, নৈবদ্যে, গীতাঞ্জলি, বলাকা, পূরবী, পুনশ্চ, বিচিত্রা, সেঁজুতি, জন্মদিনে, শেষলেখা (মৃত্যুর পর প্রকাশিত)  বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

উপন্যাস           : গোরা, ঘরে-বাইরে, চতুরঙ্গ, চোখের বালি, নৌকাডুবি, যোগাযোগ, রাজর্ষি, শেষের কবিতা প্রভৃতি।

কাব্যনাট্য           : কাহিনী, চিত্রাঙ্গদা, বসন্ত, বিদায়, অভিশাপ, বির্সজন, রাজা ও রাণী প্রভৃতি।

নাটক              : অচলায়তন, চিরকুমার সভা, ডাকঘর, মুকুট, মুক্তির উপায়, রক্তকরবী, রাজা প্রভৃতি।

গল্পগ্রন্থ            : গল্পগুচ্ছ, গল্পস্বল্প, তিনসঙ্গী, লিপিকা, সে কৈশোরক প্রভৃতি।

প্রবন্ধগ্রন্থ          : বিচিত্র প্রবন্ধ, শিক্ষা, শব্দতত্ত¡, কালান্তর, সভ্যতার সংকট।

ভ্রমণ কাহিনী      : জাপানযাত্রী, পথের সঞ্চয়, পারস্য, রাশিয়ার চিঠি, যুরোপ যাত্রীর ডায়েরী, য়ুরোপ প্রবাসীর পত্র।

পত্র সাহিত্য       : ছিন্নপত্র, রাশিয়ার চিঠি, ভানুসিংহের পদাবলী, চিঠিপত্র। 


সোনার তরী কবিতার উৎস ও পরিচিতি :  ‘সোনার তরী’ রবীন্দ্রনাথের এক উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমধর্মী কবিতা। এটি তাঁর ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত। কবিতাটি প্রকাশিত হবার পর থেকে এ পর্যন্ত এটিকে নিয়ে যত আলোচনা-সমালোচনা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তর্ক-বিতর্কের সূচনা হয়েছে, বাংলা সাহিত্যে আর কোন কবিতা নিয়ে এমনটি হয়নি। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট রবীন্দ্র সমালোচক শ্ৰী উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তাঁর রবীন্দ্র কাব্য পরিক্রমায় বলেছেন “সোনার তরী'র নাম ভূমিকায় যে কবিতাটি অবতীর্ণ হইয়াছে, তাহার অর্থ লইয়া বাংলা সাহিত্যে যত হট্টগোল হইয়াছে, এত আর কোন কবিতা লইয়া হয় নাই। বহু পণ্ডিত ও সমালোচক এই কবিতা হইতে বহু প্রকারের অর্থ আবিষ্কার করিয়াছেন।

সোনার তরী’ মূলত রূপকধর্মী কবিতা। এর ভাব বা বিষয়বস্তু একটি ছোট ক্ষেত। তার চারপাশে বাঁকাজলের নিত্য দোলন। এরই মাঝে কৃষক তার সারাজনমের কর্মরূপ ফসল সোনার ধান নিয়ে একাকী বসে আছে। গান গেয়ে তরী বেয়ে অবলীলাক্রমে মাঝি এসে কৃষকের কর্মের ফসল সোনার ধান নৌকোয় তুলে নেয়। কিন্তু কৃষককে তুলে নেয় না। কারণ, মাঝির নৌকো ছোট, কৃষকের সোনার ফসলেই তা ভরে গেছে, তাই সে (কৃষক) অনাদৃত হয়ে পড়ে আছে।

_ এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বীরেশ্বর গোস্বামীকে লিখিত এক ব্যক্তিগত পত্রে (৯ অগ্রহায়ণ, ১৩১৩ বঙ্গাব্দ) বলেছেন-“সংসার আমাদের জীবনের সমস্ত কাজ গ্রহণ করে, কিন্তু আমাদিগকে  গ্রহণ করে না। আমার চিরজীবনের ফসল যখন সংসারের নৌকায় বোঝাই করিয়া দেই, তখন মনে এই আশা থাকে যে, আমারও ঐ সঙ্গে স্থান হইবে, কিন্তু সংসার আমাদিগকে দুইদিনেই ভুলিয়া যায়।” তারপর কবি এর প্রকাশ্য ব্যাখ্যা দেন-“সোনার তরী” বলে একটা কবিতা লিখেছিলুম। এই উপলক্ষে তার একটা মানে বলা যেতে পারে। মানুষ সমস্ত জীবন ধরে ফসল চাষ করছে, তার জীবনের ক্ষেত্রটুকু দ্বীপের মত-চারিদিকে অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত-এই একটুখানি তার কাছে ব্যক্ত হয়ে আছে।


‘সোনার তরী’ কবিতার নামকরণ: ভূমিকা ও কবিতার নামকরণ সাহিত্যের এক বিশেষ রীতি বা স্টাইল। কোন কবি-সাহিত্যিকই তাঁর সাহিত্য বা শিল্পকর্মের নামকরণ নিজের খেয়াল-খুশি বা ইচ্ছামত করতে পারেন না। তাই নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প প্রভৃতির ন্যায় কবিতার নামকরণের ক্ষেত্রেও একটি সুনির্দিষ্ট বা সুস্পষ্ট নিয়ম বা রীতি অবলম্বন করতে হয়। কবিতার নামকরণ তাই এর বিষয়বস্তু অথবা অন্তর্নিহিত ভাবের উপরেই বিশেষভাবে নির্ভরশীল। এই আলোকে ‘সোনার তরী’ কবিতার নামকরণ বিচার করে দেখা যেতে পারে।


নামকরণের প্রেক্ষাপট: ‘সোনার তরী’ কবিতার নামকরণে কবি অন্তর্নিহিত ভাবের ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। কবিতাটির বাহ্যিক দৃশ্যপটে দেখা যায় বর্ষাকালের ধানক্ষেত, ভরা নদী, নৌকা এবং একজন নিঃসঙ্গ কৃষককে। এ সবকিছুই আসলে একটি রুপক আর এই রূপককেই কবি নামকরণের ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্ব দিয়েছেন।

 

সার্থকতা: মানুষ মরণশীল, কিন্তু তার সৃজনশীল কর্মের মৃত্যু নেই। বর্ষার দুর্যোগময় পরিবেশে যে নিঃসঙ্গ কৃষক তা প্রকৃতপক্ষে কবিরই আত্ম সত্তা। এই পৃথিবীতে মানুষ নিতান্তই একা ও অসহায়। এই একাকীত্বের মধ্যে তাকে ফলাতে হয় কর্মের সোনালী ফসল। এক সময় মহাকাল আসে মৃত্যুর নৌকা নিয়ে। সে নিয়ে যায় মানুষের সোনার ফসল; মানুষের ঠাই সেখানে হয় না। এ বাস্তব সত্যকে কবি রূপকের আবরণে আলাচ্যে কবিতায় তুলে ধরেছেন।

 

উপসংহার ও পরিশষে বলা যায় বিষয়বস্তুর আলোকে “সোনার তরী” কবিতার রূপকধমী নামকরণ সঙ্গত, সার্থক ও শিল্পসম্মত। যে তরী জীবনের সোনা বয়ে নিয়ে যায় অমৃতের পারাবারে কবি তার নাম দেন সোনার তরী'। তা সে লোহার হলেও সোনার, কাঠের হলেও সোনার।  সোনার তরী কবিতার বিষয়বস্তু এ সংসারের সব মানুষই কৃষক। তার কর্মময় জীবন-ক্ষেত্রটি আয়ুর দ্বারা সীমাবদ্ধ। সেখানে অনন্ত কালস্রোত ‘পদ্মার স্রোতের মত ক্ষুরধারে ছুটে চলেছে। সোনার ধান কৃষকের সারাজনমের কর্মের ফলানো ফসল। সে ক্ষেতে বসে তার কর্মরূপ সোনার ধান কেটে স্তুপীকৃত করছে। এমন সময় কালের দূত বন্যার মত এসে তার আয়ুর চারি আলি ঘেরা জীবনকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়। তার পশ্চাতেই মহাকাল নাবিকের বেশে ইতিহাসরূপ সোনার তরী নিয়ে সোনার ধানরূপ কর্ম-ফসলকে তার নৌকায় তুলে নিলেন। কিন্তু অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি মানুষকে নিলেন না। সে অনাদৃত হয়ে সেখানেই পড়ে রইল। বিশ্বজগৎ মানুষকে চায় না, মানুষের কর্মকে চায়। মানব জীবনের এটাই বড় ট্র্যাজেডি।


সোনার তরী কবিতার গদ্য রূপ:  আকাশে গর্জন করছে মেঘ, ঘন বর্ষায় কূলের মধ্যে একাকী বসে আছি, কোন ভরসা নাই। বেশি বেশি করে স্কুপে স্থূপে ধান কাটা শেষ হল। ভরা নদীর প্রবল স্রোতের বেগ ক্ষুরধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। ধান কাটতে কাটতেই বর্ষা এসে গেছে। নদীপাড়ে একটা ছোট ক্ষেত, তার মধ্যে আমি একা। আর চারদিকে প্রবল স্রোতের বাঁকাজল খেলা করছে। পরপারে আঁকা ছবির মত দেখা যায় কালচে রঙের গাছপালা। ভোরবেলাতেই সবটুকু গ্রাম মেঘাচ্ছন্ন। এপাড়ের মধ্যে আমি একাকী। গান গেয়ে নৌকা বেয়ে কে পাড়ের দিকে আসছেন, তাকে দেখে যেন চেনাচেনা মনে। হচ্ছে। ভরাপালে চলে যায়, কোনদিকে তাকায় না, ঢেউগুলো নিরূপায় অবস্থায় দুই ধারে ভেঙ্গে পড়ছে। দেখে যেন মনে হয় তাকে আমি চিনি। ওগো, তুমি কোথায় যাচ্ছ, কোন বিদেশে, অতি অল্প সময়ের জন্যে হলেও তোমার নাও কূলে এনে ভিড়াও। তোমার যেখানে খুশি সেখানে যেয়ো, যারে খুশি তারে দিও। শুধু তুমি সামান্য হেসে নিয়ে যাও আমার জমানো সোনার ধান কূলে এসে। যত তোমার মনে চায় ততই তোমার নৌকায় লও আর যখন জানতে চাইবে আর আছে? আমি বলব আর নাই, সব দিয়েছি তুলে। এতকাল নদীর কূলের মধ্যে যা নিয়ে ভুলেছিলাম সবগুলোই আজ ভাঁজে-ভাঁজে তুলে দিলাম। এখন আমাকে দয়া করে তোমার নৌকায় নাও। কিন্তু ঠাই নাই, ঠাই নাই, ছোট সে তরী—আমার সোনার ধানে গিয়েছে ভরি। শ্রাবণ মাসের আকাশ ঘিরে ঘন মেঘ ঘুরাফেরা করছে, খালি নদীর তীরের মধ্যে আমি পড়ে আছি, আমার যা কিছু ছিল তা সোনার তরী নিয়ে গেছে।


রবীন্দ্রভাষ্যে সোনার তরী: মহাকাল মানুষের কর্ম কীর্তি বহন করিয়া লইয়া যায়, রক্ষা করে; কিন্তু স্বয়ং কীর্তিমান্‌ মানুষকে সে রক্ষা করিতে চায় না। হোমার বাল্মীকি ব্যাস কালিদাস শেক্‌স্‌পীয়ার নেপোলিয়ান আলেক্‌জাণ্ডার প্রতাপসিংহ প্রভৃতির কীর্তিকথা মহাকাল বহন করিয়া লইয়া চলিতেছে, কিন্তু সে সেই সব কীর্তিমান্‌দের রক্ষা করে নাই। যিনি প্রথম অগ্নি আবিষ্কার করিয়াছিলেন, বস্ত্রবয়নের তাঁত ইত্যাদি আবিষ্কার করিয়াছিলেন, তাঁহাদের নাম ইতিহাস রক্ষা করে নাই, কিন্তু তাঁহাদের কীর্তি মানব-সভ্যতার ইতিহাসে অমর হইয়া আছে।”

বোধ হয় এই সন্ধ্যার পরদিন প্রত্যুষেই কবি শান্তিনিকেতন-মন্দিরে উপাসনা করেন এবং ঐ সোনার তরীর কথা লইয়াই উপদেশ দেন। তাহা অনুলিখিত হইলে ‘শান্তিনিকেতন’ নামক পুস্তক-পর্যায়ের সপ্তম ভাগে আমি ছাপিয়া প্রকাশ করিয়াছিলাম। সেই ব্যাখ্যা কবিকৃত বলিয়া তাহা সমগ্র উদ্ধার করিয়া দিতেছি।

তরী বোঝাই

সোনার তরী ব’লে একটা কবিতা লিখেছিলুম। এই উপলক্ষে তার একটা মানে বলা যেতে পারে।--মানুষ সমস্ত জীবন ধ’রে ফসল চাষ কর্‌ছে। তার জীবনের ক্ষেতটুকু দ্বীপের মতো--চারিদিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত--ঐ একটুখানিই তার কাছে ব্যক্ত হয়ে আছে--সেইজন্য গীতা বলেছেন--

অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।

অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।

যখন কাল ঘনিয়ে আসছে, যখন চারিদিকের জল বেড়ে উঠ্‌ছে, যখন আবার অব্যক্তের মধ্যে তার ঐ চরটুকু তলিয়ে যাবার সময় হলো--তখন তার সমস্ত জীবনের কর্মের যা কিছু নিত্য-ফল তা সে ঐ সংসারের তরণীতে বোঝাই ক’রে দিতে পারে। সংসার সমস্তই নেবে, একটি কণাও ফেলে দেবে না--কিন্তু যখন মানুষ বলে, ঐ সঙ্গে আমাকেও নাও আমাকে রাখ; তখন সংসার বলে--তোমার জন্য জায়গা কোথায়? তোমাকে নিয়ে আমার হবে কী? তোমার জীবনের ফসল যা-কিছু রাখ্‌বার সমস্তই রাখব, কিন্তু তুমি তো রাখ্‌বার যোগ্য নও!

প্রত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু-না-কিছু দান কর্‌ছে, সংসার তার সমস্তই গ্রহণ কর্‌ছে রক্ষা কর্‌ছে, কিছুই নষ্ট হ’তে দিচ্ছে না,--কিন্তু মানুষ যখন সেই সঙ্গে অহংকেই চিরন্তন ক’রে রাখ্‌তে চাচ্ছে, তখন তার চেষ্টা বৃথা হচ্ছে। এই যে জীবনটি ভোগ করা গেল, অহংটিকেই তার খাজনাস্বরূপ মৃত্যুর হাতে দিয়ে হিসাব চুকিয়ে যেতে হবে--ওটি কোনো মতেই জমাবার জিনিস নয়।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন