বিলাসী গল্পের বিষয়বস্তু। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; বিলাসী গল্প।




বিলাসী গল্পের বিষয়বস্তু। শরৎচন্দ্র; বিলাসী গল্প।

লেখক               : শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

জন্মতারিখ           : ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।

জন্মস্থান          : দেবানন্দপুর গ্রাম, হুগলী কৈশর ও যৌবন কালের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয় ভাগলপুরে, মাতুলালয়ে।

পিতার নাম        : খ্যাতনামা কথা সাহিত্যিক মতিলাল চট্টোপাধ্যায়। 

শিক্ষাজীবন        : হুগলী স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন, ১৮৯৪ সালে টিএনটি স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাস করেন। ভাগলপুর জুবলী কলেজে এফএ ভর্তি হন তবে ১৮৯৫ সালে মাতৃবিয়োগ ও দারিদ্র্যের কারণে পাঠত্যাগ।

কর্মজীবন/পেশা  : কিছুদিন কলকাতা হাইকোর্টে অনুবাদকে কাজ করেন। পরবর্তীতে বার্মা রেলের হিসেব পরীক্ষকের অফিসে পঁচাত্তর টাকা বেতনে কেরানিগিরি’র চাকরি করেন।

পারিবারিক জীবন  : শন্তিদেবী তার প্রথম পক্ষের স্ত্রী, তিনি প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে হিরন্ময়ীকে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন।

পত্রিকা সম্পাদনা    : ১৯৯৭ সালের ৪ ঠা জানুয়ারি ঢাকায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

মৃত্যু                : ১৯৩৮ সালের ১৬ জানুয়ারি, পাক নাসিং হোম, কলকাতা।


সাহিত্যকর্ম:

নাটক              : ষোড়শী (১৯২৮), রমা (১৯২৮), বিরাজ বউ (১৯৩৪), বিজয়া (১৯৩৫)

গল্পগ্রন্থ            : রামের সুমতি (১৯১৪), পরিণীতা (১৯১৪), বিন্দুর ছেলে (১৯১৪), মেজদিদি (১৯১৫), আঁধারে আলো (১৯১৫), দর্পচূর্ণ (১৯১৫), বৈকুণ্ঠের উইল (১৯১৬), অরক্ষণীয়া (১৯১৬), বিলাসী (১৯২০), মামলার ফল (১৯২০), মহেশ (১৯২৬), অভাগীর স্বর্গ (১৯২৬), সতী (১৯৩৪)

প্রবন্ধগ্রন্থ         : নারীর মূল্য, তরুণের বিদ্রোহ, স্বদেশ ও সাহিত্য, স্বরাজ সাধনায় নারী, শিক্ষার বিরোধ, স্মৃতিকথা, অভিনন্দন, ভবিষ্যৎ বঙ্গ-সাহিত্য

পুরুস্কার      : ডিলিট (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), জগত্তারিণী পদক (কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)

অপরিচিতা গল্পের বিষয়বস্তু দেখুন


গল্পের বিষয়বস্তু

বিলাসী গল্পে লেখক হিন্দু সমাজের যে চিত্র এঁকেছেন তা তৎকালীন সমাজ জীবনের বাস্তব আলেখ্য। মানুষের চেয়ে সমাজ বা আচার বড় নয়। মানুষের জন্যই সমাজ সৃষ্টি হয়েছে। মানুষই আচারকে সমাজে স্থান দিয়েছে। সেই মানুষকে অবহেলা করে আচারকে মূল্য দেওয়ার কোন মানে হয় না। তবু এই আচারসর্বস্বতা হিন্দু সমাজে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। লেখক এই আচারসর্বস্বতার এক কঠিন গল্প বিলাসী গল্পে তুলে ধরেছেন। বিলাসী সাপুড়ের মেয়ে। কায়স্থ সন্তান মৃত্যুঞ্জয় তাকে ভালবাসে। মৃত্যুঞ্জয় রূপজ মোহে বিলাসীকে ভালবাসেনি। সে ভালবেসেছিল বিলাসীর গুণে। কিন্তু এই গুণবতী বিলাসীর কোন মর্যাদা হিন্দু সমাজ দেয়নি। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় দিয়েছিল। গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বিলাসীই পাঠকচিত্তে জেগে থাকে এবং তার করুণ পরিণতি গল্পের পাঠকের চিত্তেও স্থায়ী বেদনা হয়ে জেগে থাকে। গল্পের প্রভাব বিস্তারকারী চরিত্র হিসেবে বিলাসীর নামে গল্পের নামকরণ করায় তা অর্থবহ এবং শিল্পসম্মত হয়েছে।

গল্প-সংক্ষেপ:  লেখক উত্তম পুরুষের জবানীতে 'বিলাসী' গল্পের কাহিনী বিবৃত করেছেন। লেখক নিজে এ গল্পের একটি চরিত্র। বাল্যকালে তিনি দূরের স্কুলে পড়তেন। কয়েকজন সাথী মিলে স্কুলে যেতেন। এদের মধ্যে মৃত্যুঞ্জয়ও একজন। স্কুলে যাবার পথে তারা পাকা আম, বঁইচি ফল, কাঁঠাল ইত্যাদি দেখতে দেখতে যেতেন। লেখাপড়ার দিকে তাদের মনোযোগ ছিল না। মৃত্যুঞ্জয় কথা বলত কম। আপন ভুবনে সে ডুব মেরে থাকত। লেখাপড়ায় মোটেই ভাল ছিল না। সংসারের সচ্ছলত। তার ছিল। তার মন ছিল উদার। অনেকেই তার কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা আদায় করত। মৃত্যুঞ্জয়ের মা-বাবা, ভাই-বোন কেউই ছিল না। আম বাগানের মাঝে একটা পোড়ো বাড়িতে সে বাস করত। তার এক জ্ঞাতি খুড়া ছিল। সে তার দুর্নাম রটনা করে বেড়াত। সে নিজে রান্না করে খেত। আম বাগান জমা দিয়ে ভালভাবেই তার দিন কাটত। অনেকেই তার কাছ থেকে উপকার আদায় করত কিন্তু কেউই তার সাথে সম্পর্ক স্বীকার করত না। গ্রামে তার দুর্নাম ছিল অনেক।

মাসি-পিসি গল্পের বিষয়বস্তু এখানে

মৃত্যুঞ্জয় হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাকে চিকিৎসা ও সেবা দিয়ে সারিয়ে তোলে একজন মুসলমান বাবা ও তার মেয়ে। মেয়েটির নাম বিলাসী। লেখক একদিন লুকিয়ে সাঁঝের আঁধারে মৃত্যুঞ্জয়কে দেখতে গেলেন। মৃত্যুঞ্জয় মেঝেতে শুয়ে আছে। শরীর তার কংকালসার। বিলাসী মাথার কাছে বসে পাখার বাতাস করছে। মৃত্যুঞ্জয় আস্তে আস্তে তার রোগের বিবরণ দিল। দেড় মাস রোগ ভোগের পর সে এখন কিছুটা সুস্থ। এখনও ওঠে বসতে পারে না। বিলাসীর সেবা-যত্নেই সে সেরে উঠেছে। দু'মাস পর জানা গেল মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীকে বিয়ে করেছে। বিলাসী ভিন্ন জাতের মেয়ে। তাকে বিয়ে করে তার হাতে রাঁধা ভাত খেয়ে মৃত্যুঞ্জয় জাত খুইয়েছে। তার খুড়া বদনাম রটাতে লাগল। মৃত্যুঞ্জয় যে অন্ন পাপে পাপী সে কথা বলে বেড়াতে লাগল। একদিন রাতের বেলা দশ-বার জন লোক মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়িতে ঢুকে বিলাসীকে মারধোর করতে লাগল। তারা বিলাসীকে মারধোর করে গ্রামের বাইরে রেখে এল। মৃত্যুঞ্জয়কে তারা ঘরে আটক করে রাখে, তাই সে বিলাসীকে রক্ষা করতে পারেনি। এ ঘটনার পর মৃত্যুঞ্জয় বাড়ি ছেড়ে মালপাড়ায় চলে যায় এবং সেখানে ঘর বাঁধে। মৃত্যুঞ্জয় এখন পুরা দস্তুর সাপুড়ে হয়ে গেছে। সে সাপ ধরে বেড়ায়। তাবিজ, কবজ বিক্রি করে। বিলাসী কিন্তু সাপ ধরা বিদ্যাকে পছন্দ করত না। কারণ সে জানত সাপ ধরা কৌশলমাত্র। কোন মন্ত্র বা তাবিজ-কবজ ভাওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। যে কোন সময় সাপের কামড়ে প্রাণ যেতে পারে। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীর নিষেধ শোনেনি। একদিন সাপ ধরতে গিয়ে মৃত্যুঞ্জয় সাপের ছোবলে আহত হয়। অনেক চেষ্টা করেও তাকে বাঁচানো গেল না, সে মারা গেল। বিলাসী বিরহ বেদনায় অস্থির হয়ে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করল। বুড়ো খুড়ো বাগানবাড়িটা দখল করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। সে বলে বেড়াতে লাগল যে অন্ন পাপেই মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যু হয়েছে। সকলে তা বিশ্বাসও করল। কিন্তু প্রেমের মাহাত্ম্য কেউই উপলব্ধি করতে সমর্থ হল না।


‘বিলাসী’ গল্পটি আঙ্গিকের দিক দিয়ে শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট গল্পগুলির ভেতর বৈশিষ্ট্যের লক্ষণ বহন করে। গল্পটি আত্মকাহিনী আকারে রচিত। ‘ন্যাড়া' নামক একটি পল্লী-বালকের ডাইরী থেকে কয়েকটি পৃষ্ঠা এখানে একত্রিত করা হয়েছে। বালক ‘ন্যাড়ার ডাইরীর পৃষ্ঠাগুলি কিন্তু যুবক শরৎচন্দ্রের অভিজ্ঞতায় পূর্ণ। ‘ন্যাড়া’ শরৎচন্দ্রের বাল্যকালের ডাকনাম। সুতরাং বিলাসী যে শ্রীকান্তের ভূমিকা এ সত্য অতি সহজেই গ্রহণ করা চলে এবং যে মৃত্যুঞ্জয়কে কেন্দ্র করে এ কাহিনী গড়ে উঠেছে, সেও পল্লী-বালকের পাঠশালার সাথী মৃত্যুঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের জীবন-কাহিনীকে কেন্দ্র করেই ন্যাড়া রচনা করেছে।

গল্পটি পল্লীজীবনের পটভূমিকাতে রচিত, শুধু পটভূমিকা নয় পল্লীজীবনের একটি দিক যা ‘পল্লীসমাজ' এবং অরক্ষণীয়াতে শরৎচন্দ্র আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন তারই প্রতি ‘বিলাসী’তেও আলোকপাত করতে চেষ্টা করেছেন ; গল্পটির ভেতর আগাগোড়াই যেন পল্লীসমাজকে লেখক ব্যঙ্গ করে গেছেন। সমাজপতিদের ধর্মনিষ্ঠা এবং অর্থগৃধ্রুতা এবং দরিদ্রের প্রতি শাসনের কঠোরতা তাদের ভগ্ন-দুর্বল মনের পরিচয় দান করে।

পল্লী-বালকদের কয়েক ক্রোশ দূরে পাঠশালায় যাওয়া এবং বর্ষার দিনে তাদের দুঃখ- দুর্দশার কথা লেখক নিজ জীবনের অভিজ্ঞতার বাস্তব রসে রাঙিয়ে বিদ্রূপ করে বলেছেন— “সেই দুর্ভাগা বালকদের মা সরস্বতী খুশি হইয়া বর দিবেন কি, তাহাদের যন্ত্রণা দেখিয়া কোথায় যে তিনি মুখ লুকাইবেন ভাবিয়া পান না।” কালে এরা বড় হয়ে পেটের দায়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যায়। পেটের দায়, ম্যালেরিয়ার দায় ছাড়াও আরও যে দায়ের চিত্র শরৎচন্দ্র এঁকেছেন তাতে গ্রামে বাস করা দুরূহ ব্যাপার। ন্যাড়ার সঙ্গী মৃত্যুঞ্জয় সংসারে ছিল নির্বিঘ্ন। পৈতৃক ভাঙা বাড়ি এবং কিছুটা বাগান ও জমি ছাড়া তাঁর আর কোনও সম্বল ছিল না। দূর সম্পর্কের এক খুড়া বেঁচে ছিলেন, কিন্তু তাঁর কাজ ছিল শুধু ভ্রাতুষ্পুত্রের নিন্দা করে বেড়ান। সুতরাং প্রকৃতপক্ষে স্নেহের বন্ধন যাকে বলে মৃত্যুঞ্জয়ের তেমন কিছু ছিল না। হঠাৎ মৃত্যুঞ্জয়ের মরণপণ অসুখ করল। গ্রামের এক বৃদ্ধ মালো তার চিকিৎসার ভার নিয়েছে এবং তারই মেয়ে বিলাসী যমের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে আরোগ্যের পথে নিয়ে এসেছে। খুড়া মহাশয় সমস্ত গ্রামে তুমুল আন্দোলন তুললেন। মৃত্যুঞ্জয়ের ‘অন্নপাপ' যদি সমস্ত গ্রামকে স্পর্শ করে তাহলে সনাতন হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করবার আর কোন পথই খোলা থাকবে না। খুড়ার উৎসাহে সমস্ত গ্রাম উত্তেজিত হয়ে উঠলো। মুহূর্তে লাঠি সোটা নিয়ে সবাই মৃত্যুঞ্জয়ের বাড়িতে উপস্থিত হ'ল। দলের ভেতর ন্যাড়াও ছিল। মৃত্যুঞ্জয়কে ঘরে বন্ধ করে সবাই মিলে বিলাসীকে মেরে গ্রামের বার করে দিল। এই সঙ্গে তুলনায় লেখক গ্রামের বর্ধিষ্ণু এক ব্রাহ্মণ পরিবারের বধূর দু'বছর কাশীবাসের কাহিনী ও তাকে সমাজে গ্রহণের বর্ণনাও করেছেন। তাতে পল্লীসমাজের অত্যাচারের গতি যেন আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট, আরও বেদনাময় হয়ে উঠেছে।

তাহারেই পড়ে মনে কবিতার মূলভাব প্রবেশ করুন

এরপর ন্যাড়ার দেখা সাপুড়ে মৃত্যুঞ্জয়ের সঙ্গে। বিলাসীকে বিয়ে করে সে পাকা সাপুড়ে হয়ে গেছে এবং তারা যে একান্তভাবে সুখের দাম্পত্যজীবন অতিবাহিত করছে ন্যাড়া সে সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হ'ল। সাপ সম্পর্কে ন্যাড়ার উৎসাহ একান্ত প্রবল ছিল। সেও দলে ভিড়ে গেলো। বিলাসী কিন্তু এসব তুকতাক্ মন্ত্র ও লোক ঠকিয়ে পয়সা রোজগার পছন্দ করতো না। এ নিয়ে মাঝে মাঝে মৃত্যুঞ্জয়কে বাধাও দিতো। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় এ পথেই উপার্জন করতো, কোথাও সাপ ধরার কথা হ'লে বিলাসী নানাভাবে মৃত্যুঞ্জয়কে যেতে বাধা দেবার চেষ্টা করতো। এমনি পরিবেশের মাঝে একদিন ন্যাড়া, বিলাসী ও মৃত্যুঞ্জয় সাপ ধরতে গেল। কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় আর ফিরলো না, সবার মন্ত্র-তন্ত্র উপেক্ষা করে সে চলে গেলো। এর পরের ঘটনা অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। শোকের দুঃসহ দহন সহ্য করতে না পেরে সাপুড়ের মেয়ে বিলাসী আত্মহত্যা করল। খুড়া মহাশয় একে পাপের প্রায়শ্চিত্ত রূপেই গ্রহণ করলেন। ধর্মকে আঘাত করলে, অনাচারকে সহায় করলে, এমনি ভাবেই জীবনে অধর্মাচরণের খেসারত দিতে হয়। পরে লেখকের ব্যক্তিগত মতামত দিয়ে কাহিনী সমাপ্ত হয়েছে। এদেশের লোক এ প্রেমের মাহাত্ম্যও বোঝে না, মর্যাদাও দিতে চায় না। তিনি বলেছেন—“বিবাহ ব্যাপারটা যাহাদের শুধু নিছক contract ; তা সে যতই কেননা বৈদিক মন্ত্র দিয়ে document পাকা হোক সে দেশের লোকের সাধ্যই নাই মৃত্যুঞ্জয়ের অন্নপাপের কারণ বোঝে। এমনি ভাবে উপসংহারে লেখক সমাজ ব্যাখ্যাতা এবং উপদেষ্টারূপে আমাদের অনেক কিছু বলেছেন, অবশ্য এমনভাবে গল্প শেষ করায় ছোটগল্পের আঙ্গিকের দিক দিয়ে ত্রুটি স্পর্শেছে। মৃত্যুঞ্জয় ও বিলাসীর প্রেমের মাহাত্ম্য প্রচারই লেখকের উদ্দেশ্য, আমাদের সমাজ এ প্রেমের মাধুর্যের স্বাদ জানে না বলেই পদে পদে একে অপমানিত লাঞ্ছিত করে। যেদিন মৃত্যুঞ্জয় মৃত্যুশয্যায় শেষ মুহূর্ত গুনছিল, সেদিন এই সাপুড়ের মেয়েই জীবনপণ করে তাকে যমের কবল থেকে ফিরিয়ে এনেছিল, খুড়া মহাশয় ও তাঁর সহধর্মীদের সাক্ষাৎ সেদিন ত পাওয়া যায় নি। মৃত্যুর সঙ্গে যুদ্ধ করতে হ'লে যে কত ধৈর্য, কত সহিষ্ণুতা, কতখানি দরদ লাগে সে একমাত্র সেবাকারিণীই জানে। মৃত্যুঞ্জয় বিলাসীর এই আত্মত্যাগের অবমাননা করে নি। সে তার যে প্রাণ বিলাসীর সহায়তায় বা তার কৃপায় লাভ করেছিল, নিঃসত্ত্ব হয়ে তাকেই সে প্রাণের দায়িত্ব ফিরিয়ে দিয়েছে। মৃত্যুঞ্জয় জানে যে, তার এ দেহ ও মনের পরে দাবি বিলাসীই করতে পারে, কারণ তাকে সে নবজীবন দিয়েছে। বিলাসীকে মৃত্যুঞ্জয় ভালবেসেছে। প্রেমের ঐশ্বর্যের কাছে ধর্ম, সমাজ সব তুচ্ছ হয়ে গেছে। এখানে লেখক মন্তব্য করেছেন কি . করে ভদ্রলোক ডোমের মেয়ে বিয়ে করে ডোম হয়, আর কসাই-এর মেয়ে বিয়ে করে কসাই হয়। নারী-প্রেমের এই আকর্ষণের মহিমা তিনি অনুভব করেছেন। মৃত্যুঞ্জয় উদার প্রকৃতির ছিল, তার উপর স্নেহ-প্রেমের স্বাদ সে জীবনে পায়ও নি। সেইজন্য বিলাসীর ভালবাসা তাকে আরও নিবিড়ভাবে আকর্ষণ করেছে। তার জীবনে সমাজ, ধর্ম, প্রতিষ্ঠা, মান সবই প্রেমের কাছে নতি স্বীকার করেছে। বিলাসী সাপুড়ের মেয়ে। জীবনের ভোগকে অস্বীকার করে প্রেমাস্পদকে সংসারে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবার মতো মানসিক অনুশীলন তার হয় নি। তার বাবা বাবুর সঙ্গে তার নিকে দিয়েছেন, সুতরাং বাবুর উপর তার পতিত্বের দাবিই বর্তমান। সে সাবিত্রী, রমা বা রাজলক্ষ্মী নয় যে দয়িতের মঙ্গলের জন্যে নিজে আত্মগোপন করে দূরে সরে যাবে। মৃত্যুঞ্জয় তার পিতৃদত্ত ধন, সে তার স্বামী, তাকে সে প্রাণের চেয়েও ভালবাসে। সে সাপুড়ের মেয়ে বলে তার ভালবাসায় গভীরতা কম নেই। সাধ্বী পত্নীর মতো সে মৃত্যুঞ্জয়কে ফাঁকি দিয়ে অর্থ উপার্জন করতে নিষেধ করেছে। সাপ ধরবার বায়না এলে শনি-মঙ্গল বারের অছিলায় তাকে ফিরিয়ে এনেছে। সব কিছুর মূলেই এ সত্য নিহিত ছিল যে, সে মৃত্যুঞ্জয়কে ভালবাসত এবং তা নির্ধারিত মাত্রার যে অধিক তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তার সন্দেহ অমূলক নয়। মৃত্যুঞ্জয় সাপের হাতেই প্রাণ দিল। সাপুড়ের মেয়ে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারলো না। মৃত্যুঞ্জয়হীন দিন বিলাসীর কাটলো না। সে সাপুড়ের মেয়ে, জাতে মুসলমান। দ্বিতীয় সঙ্গী গ্রহণ করবার পথে তার কোনও বাধাই ছিল না ; কিন্তু মৃত্যুঞ্জয়কে ত সে শুধু দেহই দেয় নি, দিয়েছিল তার মন প্রাণ। তাই তার বিচ্ছেদে বিলাসীর দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল। বিলাসী আত্মহত্যা করলো। এখানেও শরৎচন্দ্রের নারী-প্রেমের যে তত্ত্ব তাই সার্থকরূপ নিতে দেখি । প্রেম নারীর জীবন, এর থেকে তার কোনও পৃথক সত্তা নেই। তাই বিলাসীর প্রেমের আধার মৃত্যুঞ্জয় যেদিন চলে গেল তারপর এই নিরর্থক দেহের বোঝাটা রূপহীন দুনিয়ায় টেনে বেড়াবার কোনও সার্থকতাই সে আর খুঁজে পেলো না। সে জাগতিক বন্ধন থেকে মুক্তি নিলো।

 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
নবীনতর পূর্বতন